জীবনটা হলো জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একটা যাত্রা যেখানে নানা ঘটনা ঘটে। কখনো দুঃখ কখনো সুখ, কখনো হাসি কখনো কান্না। আজ ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩। আমার জীবনের ঘটনা সংক্ষিপ্ত আকারে লিপিবদ্ধ করলাম। জীবনের সব ঘটনা সবার মনে থাকে না। আর যা মনে থাকে তা আর ভোলে না। আজীবন হৃদয়ের এক কোনায় স্মরণ হয়ে থাকে। আমার জন্ম চট্টগ্রাম জেলায়। সেখানেই আমার গ্রামের বাড়ি। জন্মের পর তেমন কোনো স্মরণীয় ঘটনা ঘটেনি। তবে আমার জন্মের সময় আব্বু ছিল ঢাকায়। হাসপাতালে আমার আম্মুর সাথে ছিল নানু, মেজ মামি, ও তার বাবা (নানা)। আমি আবার নরমাল ডেলিভারিতে হয়েছি। যাক, এরপর আমাকে নিয়ে আনা হলো নানুর বাড়িতে। সেখানে আমার আকিকা হয়। তখন থেকেই আমার নাম হয় মোঃ একরামুল মুহতাসিব লতিফি। আর আম্মু আমার ডাকনাম রাখলেন তওসিন। আকিকার সময় আব্বু চট্টগ্রামে এসেছিলেন। আর আমার পুরো নামটা আব্বুই ঠিক করে রেখেছিল।
দিন যায়, সময় যায় আম্মু বেশিরভাগ সময় তার বাবার বাড়িতে থাকতেন। ছোটবেলা থেকে আমারও নানু বাড়িতে থাকতে বেশি ভালো লাগে। আমার আব্বু-আম্মুর বিয়ের আগে থেকে দাদা-দাদু মারা গিয়েছিল। তাই দাদা-দাদুর আদর পায়নি এবং দাদুর বাড়িতে তেমন একটা যাওয়া হতো না। ছোটবেলায় আম্মুর আদরই সবচেয়ে বেশি পেয়েছি। সবচেয়ে বেশি পেয়েছি বলতে বুঝাচ্ছি, আম্মুর পর অন্য কেউ তেমন একটা আদর করত না। আব্বু বেশিবার সময় কাজে বাহিরে থাকতেন। তবে আব্বুও আদর করতেন। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরাতে নিয়ে যেতেন, অনেক কিছু খাওয়াতেন, কাঁধে নিয়ে আমাকে রুম হতে রুমে ঘুরতেন। বয়স বাড়ার সাথে সাথে ছোট তওসিন বড় হতে শুরু করেছে। আর আম্মুর কাছে তওসিন নামটা ভালো লাগেনি বলে আমার ডাকনাম পাল্টিয়ে রাখলেন ‘তাসিব’। বয়স যখন এক বছর আব্বু চলে যায় ডুবাই। তবে দুবাইতে বেশি সময় থাকতেন না। গেলেই আবার চলে আসতেন বাংলাদেশ। ধীরে ধীরে আরো বড় হই। এরই মাঝে কোন এক গ্রীষ্মে আম্মু আমাকে নিচে শুয়ে রেখেছিলেন তখন উপর থেকে একটা পট মাথায় পড়েছিল, সেই দাগ এখনো আছে। এরপর ধীরে ধীরে বুঝ জ্ঞান হওয়া শুরু করে। তখন দেখতাম আম্মু ভাইয়াকে পড়াচ্ছেন। মাঝে মাঝে মাইরও দিচ্ছেন (হি হি হি)। ভাইয়া আমার থেকে চার বছরের বড়। ভাইয়াকে পড়তে দেখে আমারও ইচ্ছা হল পড়ার। বয়স যখন তিন বছর পার হলো তখন থেকেই ভাইয়াকে পড়ানোর সময় আমি এক পাশে বসে কাগজে লিখার চেষ্টা করতাম। আম্মু একবার দেখায় দিত যে কিভাবে ‘অ-আ,…’ লিখতে হয়। এরপর আর কলম ধরতেই দিতাম না আম্মুকে। নিজে নিজে লিখে ফেলতাম। তবে ভাইয়াকে আবার আম্মু হাতে হাত রেখে তারপর অনেক কষ্ট করে লেখা শিখিয়ে ছিলেন। এজন্য হয়তো তার হাতের লেখা এত সুন্দর। আর আমার হাতের লেখার কথা আর বললাম না। আমার বয়স যখন সাড়ে তিন বছর তখন আম্মু আমার পড়ার আগ্রহ দেখে একটি স্কুলে দেন সেটিই ছিল আমার জীবনের প্রথম স্কুল। নাম তার ‘মাদার কেয়ার ইন্টারন্যাশনাল স্কুল’। এখন আর সেই স্কুল ওই জায়গায় নেই। ওই স্কুলের মিস আমাকে খুব আদর করতেন। জানিনা ম্যাম এখন কোথায় আছে। ভালো আছেন কি? স্কুলে পড়ার সময় একবার একটা ঘটনা ঘটে গেল, স্কুলের ছাদে নাকি সাপ পাওয়া গেছে। তখন ক্লাস অর্ধেক করেই বাসায় চলে আসি সবাই। আসলে স্কুল থেকে আমার বাসা খুবই কাছে ছিল। তবে আম্মুই নিয়ে আসতো, নিয়ে যেত। একবার আম্মুর সাথে স্কুল থেকে আসার সময় একটা রিক্সা পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। চলন্ত সে রিকশা চাকার মধ্যে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দি। রিক্সাওয়ালা আঙ্কেল সাথে সাথে ব্রেক দেয় আর আম্মু আমাকে টেনে বকা দেয়। তবে এতে আঙ্গুলে তেমন ব্যথা পাই নি। এরপর বাসায় আসি। দিন যায়, সময় যায় উক্ত স্কুলের সাথে একটা মাদ্রাসায়ও যেতাম। মাদ্রাসায় এক মাস ক্লাস করে বাসায় একটা হুজুর রাখা হলো। আরবি শিক্ষার জন্য। ওই সময় আমরা যে বাসায় থাকতাম ওই বাসার সামনে খোলা মাঠ আর সেই খোলা মাঠে অনেকগুলা নারিকেল গাছ ছিল। দেখতে সুন্দরই লাগতো। আর ওই সময় শিলা বৃষ্টি হতো। জানালার ফাঁকে দিয়ে বাটিটা বের করে শিলা ধরার চেষ্টা করতাম। সময় যেতে থাকে শিলা বৃষ্টি হওয়া বন্ধ হয়ে যায়, সেই নারিকেল গাছগুলোও উধাও হয়ে বড় একটি অ্যাপার্টমেন্ট উঠল।
এরপর প্রায় ছয় সাত মাস পর আম্মু আমাকে ও ভাইয়াকে ‘গ্লোরি স্কুল এন্ড কলেজ’ নামের একটি স্কুলে দেন। সেখানে পড়ার সময় একটা মিস আম্মুকে পরামর্শ দেয় আমাকে কেজি না পড়িয়ে সময় নষ্ট না করে ক্লাস ওয়ানে দিতে। এরপর রোদ হোক, বৃষ্টি হোক, রাস্তায় হাঁটু সমান পানি হোক সব সময় স্কুলে যেতামই যেতাম। কিন্তু কেন? তার কোন উত্তর জানিনা। তারপর সেই স্কুলে এক বছর পড়া শেষ করে ভর্তি হলাম ‘মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় এন্ড কলেজ’ এ। পুনরায় ক্লাস ওয়ান এই ভর্তি হলাম। ভর্তির ব্যবস্থা ছিল লটারি সিস্টেম। বড় মাঠের সামনে বড় একটা স্ক্রিনে যারা যারা লটারিতে এসেছে তাদের রোল দেখানো হত। চার-পাঁচ ঘন্টা পার হয়ে গেল। এখনো পর্যন্ত আমার রোল না আসায় চিন্তিত। শেষ মুহূর্তে ভাইয়া বলে উঠলো, “ওই যে তাসিবের রোল আসছে।” নিশ্চিত করতে গেলাম “জিমি” নামের স্যারের কাছে স্যার বলল,” হ্যাঁ, ও নির্বাচত হয়েছে, কংগ্রাচুলেশন!”। পরদিন ভর্তির কাজ শেষ করে প্রধান শিক্ষকের রুমে যাওয়ার সময় স্কুলের গেটে পা পিছলে পড়ে যাই। হাটু থেকে রক্ত বের হচ্ছিল, প্রথমে রক্ত আমিও খেয়াল করিনি। কিন্তু প্রধান শিক্ষকের রুমে ঢোকার পর দেখি আমার পায়ে রক্ত। প্রধান শিক্ষক (আখলাক স্যার) দেখে আমাকে রুমে বসে থাকা একজন লোকের সাথে পাঠিয়ে দিল স্কুলের মেডিকেল রুমে। আমিতো অবাক। মেডিকেল থেকে এসে বাসায় যাওয়ার সময় আম্মুকে বলল,” স্কুলে তো হাসপাতালও আছে!”
স্কুলে আমার রোল সম্ভবত ৪৪৬ ছিল। এরপর ক্লাস টু, থ্রি, ফোর, ফাইভ, সিক্স, সেভেন, এইট, নাইন পর্যন্ত আমার রোল এগোতেই থাকে। রোল ১-১০ এর মধ্যে থাকার কোন ইচ্ছা ছিল না। তাই হইও নাই। দশম শ্রেণী পর্যন্ত আমি আমার স্কুল জীবনের সর্বোচ্চ রোল (৯৫)পর্যন্ত এগিয়েছি। এখন দেখি কলেজে এসে রোল ৭৭ হয়েছে। যাক এখানেও এগিয়েছে।
পঞ্চম শ্রেণীতে প্রথমবার বোর্ড পরীক্ষা দিতে যাই। নাম সমাপনী পরীক্ষা। পরীক্ষায় প্রবেশের সময় উপর থেকে কে জানি একটা স্কেল ফেলল যা ঠিক বরাবর মাথার মাঝখানে এসে আঘাত করে। মোটামুটি এটাই মনে আছে। পরীক্ষা শেষ করে গ্রামের বাড়িতে আসি। সেখানেই খবর পাই গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়েছি। তখন নানা ভাই বাজার থেকে মিষ্টি নিয়ে আসলো। এরপর জেএসসি, তারপর এসএসসি। এসএসসিতেও জিপিএ-৫ পাই। কিন্তু এবার নানুর বাড়িতে মিষ্টি আনা হলো না। ১১ই নভেম্বর ২০২১, বিকাল ৪:০০টা আমার নানাভাই ঢাকার united হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। সে সময় নানুর বাড়িতে গেলে প্রতি সপ্তাহে না হলে প্রত্যেক মাসে তিনবার ৫০০ টাকা করে নানা ভাই দিত। যাতে বাহিরে কিছু ইচ্ছা করলে খেতে পারি। সময়ের সাথে সাথে সব হারিয়ে যাচ্ছে। তবে এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্টটা ঢাকায় বাসাতেই দেখেছিলাম। বাড়িতে আব্বু মিষ্টি এনেছিল। এসএসসি পরীক্ষা শেষে সেই স্মৃতিময় জায়গা অর্থাৎ স্কুল থেকে বের হওয়ার সময় কষ্ট লাগছিল। স্কুলের সেই শিক্ষকগণ যাদের নাম না বললেই নয়, আবুল বাশার স্যার, জাহিদ হোসেন স্যার, ফয়সাল আমিন স্যার, হাবিবুর রহমান স্যার, রাজ্জাক জোয়ারদ্দার স্যার, ইব্রাহিম স্যার, জাবের স্যার, আয়েশা সিদ্দিকা মিস, রুহুল আমিন স্যার, ওসমান স্যার সহ আরো অনেকে যাদের কথা মনে থাকবে সবসময়। স্কুল জীবনে অনেক বন্ধু ছিল যাদের কথা আজীবন মনে থাকবে। তাদের মধ্যে সামি, আবিদ, তামিম, তামজিদ সহ আরও অনেকে। যাক, পরীক্ষা শেষ করে কলেজ ভর্তি পরীক্ষার জন্য রীতিমত আমাকে কোচিংয়ে দিয়ে দেয়া হলো। যেখানে যাওয়ার আমার একটু ইচ্ছা ছিল না। ইচ্ছে ছিল গ্রামে যাব সেখানে কয়েক দিন ঘুরে তারপর ঢাকায় আসবো এবং আরামসে পড়ালেখা শুরু করব। ওইভাবে হলেই হতো ভালো হতো। স্বপ্নের কলেজে হয়তো টিকতাম। অবশেষে লিখিত পরীক্ষার সময় সব বুঝে ফেললাম পরবর্তীতে কি হবে…। আর বর্তমানে অধ্যায়নরত আছি নৌবাহিনী কলেজে। এখনো ইচ্ছা স্বপ্নের কলেজে যাওয়ার, পূরণ হলো না আর। 💔
“সাফল্য মানুষের অতীতকে দেখে না, দেখেনা তা বংশ পরিচয়, দেখে না সে কি, সাফল্য আসে বর্তমান কে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর মাধ্যমে অর্থাৎ সাফল্য দেখে বর্তমান সময়কে।”
জীবনের গল্প
What’s your reaction?
Love0
Sad0
Happy0
Leave a Reply